top of page

কান্নাজাগানিয়া

 

দিলু নাসের

dilu and monju.jpg

প্রিয় বন্ধুবর কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু। কি নামে ডাকবো আজ তোমাকে? গেওর্গে আব্বাস, মঞ্জু মিস্ত্রাল, অভিজিৎ কুণ্ডু, ভ্লাদিমির জয়নু্‌দ্দীন, না মঞ্জু হোসেন? জানি কোন নামে ডাকলেই তোমাকে পাবোনা, আর সাড়া দেবেনা ।তুমি তো পাড়ি জমিয়েছো সুদূরে, সুনীল আকাশে তারাদের ভিড়ে। আজন্ম তুমি আড়াল ভালোবাসতে, তাই সত্যিই সবার চোখের আড়াল হলে আজ। তোমার এই অন্তর্ধান বড়ই কষ্টদায়ক বন্ধু।

তুমি অনেকবার বলেছো মানুষ মরণশীল এই কথাটি চিরন্তন সত্য। সকল মানুষকেই মৃত্যুর সাধ গ্রহণ করতে হয়।কতোবার বলেছো মৃত্যু জীবনের অনিবার্য অংশ; মৃত্যু ব্যতিরেকে জীবনের পূর্ণতা আসে না।বলেছো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’ তার মানে এই নয় বন্ধু,তোমাকে অসময়ে চলে যেতে হবে?

সকল মানুষকেই মৃত্যুর সাধ গ্রহণ করতে হয়।কতোবার বলেছো মৃত্যু জীবনের অনিবার্য অংশ; মৃত্যু ব্যতিরেকে জীবনের পূর্ণতা আসে না।বলেছো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’ তার মানে এই নয় বন্ধু,তোমাকে অসময়ে চলে যেতে হবে?

তোমার এই তীরোধানে স্মলহিথ পার্কের গোলাপ হয়ে গেছে পাথরের ফুল। তোমার বিরহে প্রিয় নগর বার্মিংহামে রোদ উঠেছেনা। কভেন্ট্রি রোডের বিশাল মেপল বৃক্ষ গুলো পাতাহীন দাড়িয়ে রয়েছে। আর তোমার স্বজনদের চোখে ঠাঁই নিয়েছে মহা সাগর। হৃদয় ছিড়ে বেড়িয়ে আসে কেবলই কান্নাজাগানিয়া।

তুমি নেই ! এই পৃথিবী থেকে প্রস্থান করেছো, এ কথাটি আমাকে একদিন লিখতে হবে তা কোনোদিন চিন্তাও করতে পারিনি।লিখতে হবে তোমার এলিজি এযেন অকল্পনীয়। ভাবছি আমি যদি তোমার আগে মৃত্যুবরণ করতাম তাহলে কেমন হতো আমাকে নিয়ে লেখা তোমার রচনাটি? নিশ্চয়ই সেটি হতো সর্ব উৎকৃষ্ট। কারণ  এপর্যন্ত আমার জন্য তুমি যতোটি বাক্য ব্যয় করেছো সে গুলো আমার জীবনের পরম সম্পদ।

একবার লিখেছিলে “একজন দ্রষ্টা এবং বহু মাত্রিক দিলু নাসের, শিরোনামে- তাঁর কর্মযজ্ঞ একদেশদর্শী নয় , বহুতা বিস্তৃত। তাঁর কর্মযজ্ঞ  ব্যাপক হলেও মৌলিক রচনার ক্ষেত্রে তিনি  সর্বদাই সর্তক এবং নন্দনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রাতীত”

মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে আমার সম্পর্কে তোমার শেষ উচ্চারণ “দিলু নাসের এর ভূমি  কর্ষণ তথা শব্দ কর্ষণের পথ দীর্ঘ এবং অঙ্গুলিমেয় নয়। ব্যাপক। 
হায়! ওজনীসম্ভূতা!
সৃষ্টিশীল কর্মের পাশাপাশি তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মও নিরঙ্কুশভাবে  অসমালোচিত এবং সর্বজনবিদিত। যাত্রা অব্যাহত থাকুক এবং একথাটি আবার বলা হোক- মেনি মাইলস টু গো বিফর আই স্লিপ...”  

 এই দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু সম্পর্কে আজ কি লিখবো আমি? তোমার মতো বাক্য নির্মাণের ক্ষমতা তো আমার নেই বন্ধু।

আমাকে নিয়ে লেখা লেখা তোমার বাক্য গুলোই আজ তোমাকেই উৎসর্গ করতে চাই । বলতে চাই প্রিয় বন্ধুবর “এই মণিহার আমায় নাহি সাজে..” এগুলো কেবলই তোমার জন্য।তোমার এই অমূল্য বাক্যের বোঝা আমি বইতে পারবোনা । তোমার স্মৃতি, স্বর্গীয় হাসি আর ভরাট কণ্ঠ আমাকে এক মুহূর্তও স্থির থাকতে দেয়না। ঘুমের মধ্যে আমি ডুকরে উঠি।আমার চোখে জমে লবনের পাহাড়।রাত দশটা হলে  টেলিফোন বেজে উঠলেই মনে হয় এই বুঝি তোমার ভরাট কণ্ঠ ভেসে উঠবে ..হ্যালো কবি। হায়! ত্রিকাল অন্বেষী কবি কি করে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। এই তো মাত্র এক বছর আগে এক মধ্য রাতে আমার কবিতায় দুটি লাইন তুমি সংযোযিত করেছিলে।

মরে গেলে শুয়ে রবো পাথর ছিদ্রে, জন্মান্ধ কবরে, অচিন কুয়াশা শহরে।

এই কথা গুলো এতো তাড়াতাড়ি কি ভাবে সত্য হলো?  এ যেনো

অলৌকিক কবিতা।শুধু তাই নয়, তিন বছর আগে লেখা তোমার ক্যান্সার আক্রান্ত কবিতা গুলো পড়লে মনে হয় প্রস্থানের খবর যেন তুমি আগাম জেনেছিলে। না হলে কি করে এমন চিরন্তন ও শাশ্বত কথা তুমি সৃষ্টি করলে?

প্রিয় বন্ধুবর, তোমার কবিতা, গল্প, আর মুক্তগদ্য নিয়ে লেখার ভাষা আমার নেই।তুমি অনেক আগে কথাচ্ছলে আমাকে বলেছিলে –“আমি জীবনানন্দ হবো” তাই হলো বন্ধু । বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ-এর পরে যে ক’জন আত্মবিধ্বংসী কবির নাম উচ্চারিত হবে তাদের মধ্যে তুমিও একজন। তুমি চলে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তোমার একটি সদ্য রচিত কবিতা পড়ে আমি কবিতাটিকে আত্মবিধ্বংসী রচনা বলে আখ্যায়িত করেছিলাম।শুনে তুমি মধ্যরাতে ফোন করে আমাকে যে কথা গুলো বলেছিলে তা এখনো ফোনের ভেতরে ধারণ করা আছে। তুমি বলেছিলে “এরাই আত্মবিধ্বংসী যারা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ইতর, চরিত্রহীন, লম্পট এবং অসহনীয় পর্যায়ের সৎ, নির্লোভ, আত্নপ্রবঞ্চক ও ভাবপ্রবণ, স্ববিরোধ তৈরির অসীম শক্তিমত্তা ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিপুলভাবে জ্ঞানী, সন্ত, ধৈর্য ও স্থৈর্য্যশীল, ঘুমঘোরে দুধের মাংস আর শাক-সবজির গুগ্ধপান করে থাকে স্বর্গ-নরকের চূড়ান্ত চূড়ায় বসে, যারা ঈশ্বর ও প্রকৃতির মতো মহৎ মিথ্যেবাদী, নিষ্ঠুর ও দয়ালু, যাদের রচনায় অনাড়ম্বর নেই, বাহদুরীর বদলে রয়েছে ধূলিধূসরিত গহীন গন্তব্য, ধুলোর আড়ালে হীরক ফলের উদ্যান যেমন জাজ্বল্যমান...যারা সমাজসৃষ্ট পরিদৃশ্যমান বাস্তবতার কাছে নির্লজ্জ এবং অপাংক্তেয় অন্যদিকে অন্তর্মুখী, চিরঅভিমানী...প্রায়শ: উৎফুল্ল তারা মিথুনরত পিপীলিকা দর্শনে, ভীষণ বিরক্ত মনুষ্য প্রজাতির মিলনকর্মে...চন্দনের চর্বির সাথে অচিন জানোয়ারের মেদ-মাংস মিশিয়ে দিয়ে যারা হয়ে ওঠে গন্ধবণিক, তারাই মূলত: আত্নবিধ্বংসী কবি। 

''একজন্মে মানুষ কবিতা লিখতে পারে না, মানুষ কবিতা লেখে মৃত্যুর পরে।'' অন্তরাত্মার এই অসহায়ত্ব ধারণ করে মানুষ কবিতা লেখা আয়ত্ত করেছে- এ এক আশ্চর্য বিষয়। আর সবচেয়ে অত্যাশ্চর্য বিষয়- মানুষ নির্মাণ করছে আত্মবিধ্বংসী কবিতা, আত্মা ও আত্ম-উন্মোচনের তীব্রতা থেকে। এ যেনো অলৌকিক কবিতা, লৌকিকতা অস্বীকার করে নয়; ত্রিশ দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার অত্যুজ্জ্বল প্রতিনিধিত্বই নয়, বরং পৃথক আত্মা নিয়ে পৃথক অনুভূতিতে, যুগ-চেতনায়, ঐতিহ্যে, পাণ্ডিত্যে সনাক্তযোগ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত । আত্মবিধ্বংসী কবিতা লঘু-চেতা কোনো সন্ন্যাসীতত্ত্ব নয়, আবার চূড়ান্ত বাউলিয়ানা অস্বীকার করে নয়; পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ পাণ্ডিত্যে ন্যুব্জ নয়। কবি যেনো মহাসমুদ্রে এঁকে দিচ্ছেন চিহ্ন-রেখা, বাতাসে দস্তখত দিয়ে পাখিদের দেহ হতে মাধ্যাকর্ষণ চিরে দিচ্ছেন। এ কোনো সুখী-সমৃদ্ধশালী একাডেমি শিক্ষিত মিস্ত্রিবিদ্যকের কবিতা নয়। যারা আত্মবিধ্বংসী তারা আত্মজিজ্ঞাসু। শুধু তত্ত্ব আর যুক্তি দাঁড় করিয়ে গৌণ কবিদের মত পরিতৃপ্ত নন, বরং জিজ্ঞাসা আরো তীব্র, আরো দৃঢ়মূল হয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, অনুভবের কেন্দ্রীয় উৎস হতে। অতৃপ্ত কবি মহাশূন্যে ছুঁড়ে দেন প্রশ্নবিদ্ধ সত্তার শলাকা। নিকটতম সূর্যকে হত্যা করতে চান অথবা নিজেই দৃশ্যমান হতে চান বিন্দু বিন্দু হয়ে নিজের কাছে। ঈশ্বর, নদীনালা, পুষ্প, প্রজাপতি হত্যার মাধ্যমে বোধ করি কবি একসময় আত্মবিধ্বংসী হয়ে ওঠেন তার রচনায়, কখনো কখনো নৈমিত্তিক জীবন যাপনেও। কবি যখন চূড়ান্ত সমর্পিত- একটা লাল বন-পিঁপড়াকে হত্যার মাধ্যমেই যেনো হত্যা করা হল সারাটা প্রাণীমন্ডলী। কবির বিরোধ তৈরি হয় যাপিত জীবন, রাষ্ট্র, ধর্ম, প্রথা, রাজনীতি, অর্থনীতি, অকবি, গৌণ কবির সঙ্গে। সর্বকালে, সর্বভাষায়ই গৌণ কবির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এখনতো এমনই যে, কবিতা লেখার মত সহজ আর মরীরী কাজটুকু যেন দ্বিতীয়টি নেই।“

বন্ধু তুমি সততই বলতে যে ‘একজন্মে মানুষ কবিতা লিখতে পারে না, মানুষ কবিতা লিখে মৃত্যুর পরে।“

এটাই সত্যি হলো বন্ধু। তোমার মৃত্যুর পর আমরা বারবার তোমার কবিতা পাঠ করছি আর নতুন করে তোমাকে আবিষ্কার করছি।প্রতিদিন মানুষের মনে তুমি লিখে যাচ্ছো নতুন কবিতা। তুমি যে  আত্মপ্রচারিত গৌণ কবিদের মত সুখী সমৃদ্ধশালী হাজার হাজার নির্বোধের তালিকায় নিজকে কেন অন্তর্ভুক্ত করেননি তা এখন আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। এখন বুঝতে পারছি তুমি ছিলে মৌলিক কবি। ছিলে কবিদের কবি।

গত বিশ বছরে প্রায় প্রতিরাতে তোমার-আমার যে ফোনালাপ হতো তখন আলাপচারিতার বিষয় ছিল অস্তিত্ব, ধর্ম, মৃত্যু, যৌনতা, কবিতা, রাজনীতি, দর্শন আরো কতো কিছু। বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন ভাবে, সক্রেটিস, এরেস্টেটল, মুহাম্মদ,(স) ঈসা,মুসা, জ্যা পল সার্ত্রে,আইনস্টাইন্, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জালালা উদ্দিন রুমি, দারিদা, শামসুর রাহমান, সৈয়দ হক,দিলওয়ার পর্যন্ত আমাদের আলোচনায় আলোচিত হয়েছেন।দীঘ আলাপচারিতায় আমরা একজন আরেকজনকে অনুধাবন করতে পারতাম।প্রায় প্রতিরাতে আমরা ঝিঝি পোকার মতো কথা বলতাম। কিন্তু আমাদের কোন কথাই যেন শেষ হতোনা। এইতো কয়েক সপ্তাহ আগে তোমার সাথে যখন শেষ কথা হলো তখন মরণব্যাধি ক্যানসারে তুমি বিধ্বস্ত, এই প্রথম তুমি করুণ কণ্ঠে বললে-কবি অনেক কিছু করার ছিলো পালরামনা, প্রত্যুত্তরে আমি কিছুই বলতে পারিনি।টেলিফোন রেখে দেবার পর তোমার কবিতা মনে পড়লো -

“পাখিটা কানের পাশ দিয়ে ফুড়ুত করে যাওয়া আসা করে
দোয়েল পাখিটা ধরতে পারি নি
মৃত্যু, তোমায় ধরে ফেলেছি।“

 

বন্ধুবর

ইদানীং তুমিহীন রাতগুলো বড় দীর্ঘ মনে হয়। মুঠো ফোনে আর তোমার নাম ভেসে উঠেনা।তোমার বিরহে প্রাণপাখি নিথর।শুধু ভাবি তুমিহীন এ ধরায় কিভাবে মূর্খদের মেলায় সুন্দরের ক্রীতদাস হবো?

bottom of page