top of page

আমি ও গেওর্গে আব্বাস

 

 

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মঞ্জুভাইটা মরে গেলো। চরম খারাপ কাজ করলো।

মঞ্জুভাই মানে বিদ্যুতের বাগানের একচ্ছত্র অধিপতি কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু। তার অন্য নাম গেওর্গে আব্বাস।

মাঝখানে বেশ কয়েকমাস মঞ্জুভাই ফোন-টোন দেন নাই। আমি ফেসবুকও চালাই না। ভাবলাম বোধহয় কোনো কাজেটাজে ব্যস্ত। গতমাসের শেষে দিকে হঠাৎ আসমা অধরার কাছে খবর পেলাম উনার ক্যান্সার। আমি মিলটন রহমানের কাছে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, না ক্যান্সার না। আমার সন্দেহ হলো। ওই রাতেই মানে ১৯ অক্টোবর ২০১৮ মঞ্জুভাইকে ইমেইল লিখলাম—
‘মঞ্জুভাই, শুনেছি আপনি মারা যাচ্ছেন, আপনার কঠিন ক্যান্সার? আপনিও দেখি আত্মবিধ্বংসী কবির তালিকায় চলে গেলেন। যাই হোক, হ্যাপি জার্নি টু ইটার্নিটি। মানুষ তো মৃত্যুর পরই কবিতা লিখে, তাই না? আপনাকে মিস করবো।’

পরদিন মঞ্জুভাই আমাকে ‘বিষুববৃক্ষ অথবা শাদামাছি’ নামে তার নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ করতে দিলেন। আমি তাকে প্রচ্ছদ করে দিলাম। পরদিন মানে ২১ অক্টোবর আমাকে ফোন দিলেন। বললেন এতদিন হাসপাতালে ছিলেন, চেতন-অবচেতনের মধ্যে ছিলেন। তাই ফোনটোন দিতে পারেন নাই।

আমি সাঁতার-কাটা মানুষ
এখন হাঁটতেই ভুলে গেছি
এখন থেকে আমার কোনো হাত নেই, পা নেই, চোখ নেই
অস্তিত্ব বিলীন হলো দক্ষিণে

প্রিয় দক্ষিণ
অন্য কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গে নয়
আমরা এক সঙ্গেই মারা যাব…

 

=======

 

আজ নগর- বার্মিংহাম রোদ উঠেছে
আমি বলছি না- আজ প্রিয়জনের রক্তে রোদ লাগবে
ধীরে তা দুধ হয়ে যাবে…

বরং কোথাও না কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে

যাচ্ছি
যাচ্ছি
যাচ্ছি
একা একা যাচ্ছি আমার জানাযায়

তবে এর মধ্যে চেতন-অবচেতনের মধ্যে যে ঘোর সেই ঘোরের মধ্যে বসে তিনি একটা কবিতার বই লিখে ফেলেছেন। সেই বইয়ের নামই ‘বিষুববৃক্ষ অথবা শাদামাছি।’ বইটা প্রকাশ করবে অনন্যা। উনার কণ্ঠস্বর খুব দুর্বল মনে হলো। তারপরও সেদিন শেষবারের মতো আমার সঙ্গে প্রায় ১৫ মিনিট কথা বললেন। কতো কথা! শেষে উনাকে বললাম, ‘মঞ্জুভাই এইভাবে চলে গেলে হবে না। আপনাকে মৃত্যুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাঁচতে হবে।’

উনার সঙ্গে আমি অনেক রসিকতা করতাম। মজা করতাম। সেইদিন উনার মনখারাপ ছিলো বলে মনে হলো। আমি ভাবলাম উনাকে হাসাতে পারি কিনা দেখি। আমি বললাম, মঞ্জুভাই, ‘যখন আজরাইল এসে আপনার পৈথানে দাঁড়িয়ে সালাম দিবে, আপনি অবশ্যই তার সালামের উত্তর দিবেন না। তাহলে সে ফিরে যাবে। সম্ভব হলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন।’

মঞ্জুভাই হো হো করে হাসলেন দুর্বল শরীর নিয়ে। বললেন, ‘কী বললেন, আজরাইলের সালামের উত্তর দিব না?’

বললাম, ‘ হ্যাঁ, মঞ্জুভাই। আমার বাবা সালামের উত্তর দেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন।’

তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে এইভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে, স্রষ্টার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাঁচতে হবে।’

‘হ্যাঁ, মঞ্জুভাই আপনাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে হবে। আপনি অবশ্যই আজরাইলের সালামের উত্তর দিবেন না।’ এটা ছিলো তার সঙ্গে বলা আমার শেষ বাক্য। এরপর পরে আবার ফোন দিবেন বলে কেটে দিলেন। মনে হচ্ছিলো হাঁপাচ্ছিলেন। তারপর আর তার ফোনে কথার বলার অবস্থা মনে হয় তেমন ছিলো না। তবে কয়েকদিন পর ৩১ তারিখ উনার ‘অনবদ্য ইতর’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ করতে বললেন। ওটাও করে দিলাম।

আমি অবশ্য আরো ২/৩ বছর আগেই অনুমান করেছিলাম উনার এমন কিছু হয়েছে, যখন তিনি তার ‘ক্যান্সার আক্রান্ত কবিতা’ নামের একটা পাণ্ডুলিপির প্রচ্ছদ করতে দিলেন। কবিতা পড়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মঞ্জুভাই, আপনারও কি ক্যান্সার হয়ে গেলো নাকি?’ তিনি বললেন, ‘ওইরকম কিছু না। ডাক্তার দেখাচ্ছি।’ বলার সময় কেমন লজ্জা পাচ্ছিলেন মনে হলো।

 

মঞ্জুভাইয়ের সঙ্গে আলাপ সামহয়্যারইনব্লগের মন্তব্যের ঘরে—যখন প্রায় সারারাত জেগে ব্লগিং করতাম। তিনি প্রথম আমার ব্লগে আসেন প্রায় ১০ বছর আগে, ২০০৮ সালের শেষের দিকে গেওর্গে আব্বাস নামে। কারো নামের শেষে আব্বাস থাকলেই আমার প্রথমেই ইন্ডিয়ান সিনেমা পরিচালক দুইভাই আব্বাস-মাস্তানের কথা মনে পড়ে যায়। শেষে মাথায় থাকে কেবল ‘মাস্তান’ শব্দটা আক্ষরিক অর্থে। তো মঞ্জুভাইও প্রায় মাস্তানের ভঙ্গিতেই আমার-সহ নানাজনের কবিতার  পোস্টে মন্তব্য করতে থাকলেন। উনার ব্লগে গিয়ে লেখা-টেকা পড়ে সন্দেহ হলো। চেনা লেখা। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম উনি আসলে কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু। এবং কয়েকবছর ধরে উনার একটা কবিতার বই আমার কাছে। বইয়ের নাম ‘মৌলিক ময়ূর’। তো ব্লগ ঘাটতে গিয়ে সেই সময়কার কয়েকটা পোস্টে আমার কবিতা নিয়ে তার মন্তব্য পেয়ে গেলাম। সব খুঁজে দিতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে হয়তো। তাই হাতের কাছে শুরুর দিকের যেকটা পোস্ট পেলাম তাইই দিলাম এইখানে। তেমন কোনো সম্পাদনা করলাম না। কেবল আমার কবিতাগুলি টানাগদ্যে করে দিলাম। আর অপ্রয়োজনীয় দুয়েকটা আলাপ, শুভরাত্রি-টাইপ কথা ফেলে দিলাম।

 

২৭  ডিসেম্বর ২০০৮ রাত ১২:১৫

আমি : সে মুখোশের আড়ালে মুখবিহীনকে নিলো। তার ঘ্রাণশক্তি ক্রমশ বাড়ছিলো। মাটি আর জোছনার রতিগন্ধও নিলো। তুলে রাখলো ফুলদানিতে একা। ফুলদানি পোড়ামাটি, নকশাকরা দ্বিতীয়প্রহর। বেহাগের ঝিরি উড়ে আসে ধীরে। অশ্রুতপ্ত শীতকাল ছাইবর্ণ কাঁপে। কোথাও আকাশ হয়ে আছে হিম। সে মুখোশের কারিগর। সে চেনে জলের শুদ্ধতা। মুখহীনছায়া শূন্যতার আততায়ী। সে প্রতিরাতে আমাকে ছায়াছিন্ন করে।

এখানে নীলাভ ঘুম থির। তোমাকে ছুঁয়ে যাওয়া জল। তুমি একটি পাতায় তিরতির। কেঁপেছিলে রোদের কোমল। তারপর এই বলে সে চলে গেলো। চলে গেলো। আমাদের দেশে নেই শঙ্খ। আমাদের দেশে নেই পথাবাস। নীরব নগ্নতা তাল।

গাছ তার একটি পাতা ছুঁড়ে মারলো আমার গায়ে। আমি তার নগ্নতা দেখলাম সুন্দর। তলজুড়ে বিস্তারিত তার পাতার চাদর। এই বাস শীত ধীরে করেছে হরণ। আজ বসন্তদিন। আমরা পরস্পর ফিরিয়ে দেবো গান শয্যা আর বসন।

তোমাদের নীলিমা দেখো আমি আকাশ বানিয়ে দিলাম। ওখানে নীল নেই কেমন হলুদ আলো জ্বলে। মাইল মাইল বিস্তারিত রোদ জমাট বাঁধে প্রত্যাখ্যাত। এলাচের বোঁটায় ঘুমিয়ে পড়ে উপশহরের মাছি ও শঙ্কা। তোমরা উরুতে এঁকে রাখো ডাহুকপাখি। আমি খরা চিনে বলে দিই নদ ও খামারের গাঢ়তর সুর। যেখানে ছিলাম আমি শিশুদের পেলব নখের ভাঁজে প্রত্নমাটি লিখে তার নাম। তোমরা এখনো জানতেও পরো নি পাতার গন্ধ সবুজ।

মঞ্জুভাই :  ভ্রমণ করে গেলাম। ভালো লেগেছে বলে গণ-ভালোলাগা প্রকাশের বদলে যে-কথাটি বারংবার মনে হলো প্রকাশ করি সে-টিও বলতে দ্বিধান্বিত হই এ জন্যে যে, ‘করে কাঁপে’— ‘অশ্রুতপ্ত শীতকাল ছাইবর্ণ ধারণ করে কাঁপে।’ পর পর দুটি ক্রিয়াপদের ব্যবহারে সতর্ক হলে ভালো হতো।

‘গাছ তার একটিপাতা ছুঁড়ে মারলো আমার গায়ে। আমি তার নগ্নতা দেখলাম সুন্দর।’ বাক্যগুলো কেন এলোমেলো হলো না। প্রথম বাক্য পাঠ করে দ্বিতীয় বাক্যে যাত্রা দুর্লক্ষ্য। তাৎক্ষণিক উপলব্ধি জানিয়ে যাওয়ায় আশা করি মনে কিছু নেননি। আর আমি নিজেও জানি এগুলো কোনো কবিতার আলোচনা নয়—কবিতার আলোচনা হবে অন্যকোথাও, যদি শূন্যস্থান রাখেন।

‘বেহাগের ঝিরি উড়ে আসে ধীরে’ ক্রিয়াপদ হজম করতে অসুবিধা না হওয়ার কারণ হলো সুন্দর প্রয়োগ…। ভালো থাকুন, কবিতায় থাকুন। …আর আমরা তো জানি জগতের সব ভাষ্যে মিস্ত্রিবিদ্যকের অভাব নেই, কবির বড় অভাব।

…আপনার এ লাইনগুলো মনে ধরলো—‘আমি হয়তো নিজস্ব স্বর রপ্ত করতে পারিনি এখনো। তাই অন্যের সঙ্গে গুলিয়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই আমার অক্ষমতা। কথা দিচ্ছি, একদিন সত্যি সত্যি কবিতা লিখে ফেলবো।’ ঠিক এ-রকম কথা বলত সফি সরকার। কবিতায় শ্লোগান যদিও পছন্দ করি না, কিন্তু সফি যখন লিখলো, ‘দেখা হবে, দেখা হবে নারীর ভেতর.. ’ তখন স্ববিরোধী হই। সফির জন্যেই যুক্তি দাঁড় করাই—কবিকেই মাঝে মাঝে নিতে হয় ঈশ্বরের ভূমিকা। এই ব্লগে সফির কবিতা যখন কেউ পড়েনি, সে-দিনই ভেতরে স্থির করেছি ব্লগ সংস্কৃতি কবিদের জন্য নয়, ব্লগারদের জন্য। লজ্জার বিষয় হলো অনেকের মন্তব্য অংশে সফির কবিতা সংযোজন করে আসার পর অনেকেই (সম্ভবত ফাজলামো করে) বলেছে—এইটা কী? অথচ তারা নিজেরাও একপ্রকার কবিতা রচনা করেন। কবিতার জন্ম হোক। কবিতার জন্ম হোক।

 

২৮ ডিসেম্বর ২০০৮ রাত ১:০৮

আমি : আমার কাছে সবকিছুর উপর হলো কবিতা। একটা কবিতা লেখার জন্যে আমি অনেককিছু ছাড়তে পারি। আমি শেষপর্যন্ত একটা কবিতা হলেও লিখতে চাই। আমি এখানে স্রেফ ব্লগিং করতে আসিনি, আমার সকল দীনতা নিয়ে এসেছি শুদ্ধ হবো বলে। কারণ সত্যি সত্যিই কবিতা লিখতে চাই, একটা সত্যিকারের কবিতা। আমার একান্ত কবিতা। সুতরাং মনে কিছু নেয়ার প্রশ্ন অবান্তর। আমার ধ্যান পুরোপুরি শিল্পন্দনে, যার ভিত্তি রচনা করেছে কবিতা-ই। …  ক্রিয়াপদের ব্যাপারটা ঠিক করার চেষ্টা করেছি, দেখুন আরেকবার।

মঞ্জুভাই : ব্লগলেখা অনেকটা অর্ধলেখার মতোই মনে হচ্ছে, কারণ যা বলতে চাচ্ছি তা-ও আধো বলার মধ্যে থেমে যাচ্ছে। সে যা-হোক, ‘ক্রিয়াপদের ব্যাপারটা ঠিক করার চেষ্টা করেছি, দেখুন আরেকবার।’—আসলে ঠিক বা ঠিক হয়নি সেটা বলারও কেউ নই আমি; তবে ক্রিয়াপদ ব্যবহারে শ্রুতির বিষয়টি খেয়াল করলে ভালো হয় বলেই মনে করি। বিন্দুবাদী কবিতাও তো রচিত হলো ক্রিয়াপদ উপেক্ষা করার জন্য। কিন্তু আমরা তো কবিতাই পড়তে চাই…

 

 

১০ মার্চ ২০০৯ ভোর ৪:৩৭

আমি : জোছনাপায়ী এসেছি। দেখো বুকের ভাঁজ খুলে। একটি আঙুল রেখো নিঝুম। বিদীর্ণ চাঁদ অধরের ভুলে। রজঃস্বলা রাত এলে কতোদিন ঘুমিয়ে পড়েছি। হাত দুটি বুকে নিয়ে শূন্যতা। রাত আমাকে ঘিরে থাকতো বিদেহি রতিরক্ত। আজও কি তবে রাত অশরীর। কিংবা অর্ধেক শরীর খুলে প্রজাপতি-দিন হবে। আমি তো নদীর পলাতকা পথ, বুকে ভাঁজ করি জলের মরদেহ। Here the night is still dark & young & kite, Come lets drink the darkness & night. Come lets be drunk be drunk babe, Come take me away from the cave. Let me live in a star of your eternal skies, Let me sink into the epic of your eyes. আমি কখনো নিম কখনো হরিতকী, রক্ত চিরে দেখি দূরের জোনাকপাখি।

 

মঞ্জুভাই : কখনো মরদেহ, কখনো প্রজাপতি।

আমি : নদীর যে পলাতকা পথ পালিয়ে হলো সরোবর, ওখানে জল স্রোতহীন স্থির এবং মৃত। জলের এই মরদেহ ধারণ করে আছে পূর্বজন্মের স্মৃতি। এইজল একদিন স্রোতস্বিনী প্রজাপতি ছিলো।

মঞ্জুভাই : জল মঙ্গলম। দুষ্প্রবেশ্য মনে হয়নি। তারিখ, সময় অনুল্লিখিত থাকায় পাঠে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না-হওয়ার পাশাপাশি রচনার সঙ্গে চিত্রশিল্প সংযোজিত যেহেতু হয়নি, ফলে বিবিধ অবজেক্ট প্রবেশ পথে অযাচিত দাঁড়িয়ে থাকেনি। শূন্যতার জন্য যদি কবিতা হয় তাহলে তো ভাবের সর্বোচ্চ দশায় অবজেক্টিভ অক্ষরকেও ক্লান্তিকর মনে হওয়ার কথা। হায়! কবিতা লিখতেও অক্ষরের দ্বারস্থ হতে হয়। নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের প্রিয় চিত্রকল্প এবং সংকেত রচিত হতে পারে আলোর অক্ষরে।

আমি : ঈশ্বরের ক্লেদাক্ত ডোবায় শুয়ে থাকে গতকাল মহিষাসুর। নিধান ও নৈর্ঋতের ত্বকে শস্যরূপ কামনা আরও স্থির। তোমরা উরুতে এঁকে রাখো ডাহুকপাখি।

 

১৬ জুলাই ২০০৯ ভোর ৫:১১

আমি : তোমাদের নীলিমা দেখো আমি আকাশ বানিয়ে দিলাম। ওখানে নীল নেই কেমন হলুদ আলো জ্বলে। মাইল মাইল বিস্তারিত রোদ জমাট বাঁধে প্রত্যাখ্যাত। এলাচের বোঁটায় ঘুমিয়ে পড়ে উপশহরের মাছি ও শঙ্কা। তোমরা উরুতে এঁকে রাখো ডাহুকপাখি। আমি খরা চিনে বলে দিই নদ ও খামারের গাঢ়তর সুর। যেখানে ছিলাম আমি শিশুদের পেলব নখের ভাঁজে প্রত্নমাটি লিখে তার নাম। তোমরা এখনো জানতেও পরো নি পাতার গন্ধ সবুজ।

মঞ্জুভাই :  আপনার লেখায় স্রোত এসেছে। ছন্দের আড়ষ্ট ভাব দূর হওয়ায় মোটেও দুষ্প্রবেশ্য নয়। সিলেকশান অ্যান্ড কম্বিনেশন সুন্দর। অন্যরকম লাগলো। দূরে তাকাও একটু দূরে। একটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে শান্ত চোখ। তাকে কি চাইলেই ছুঁতে পারো? থামো, বোকামি করো না। এইপথ কেবল সেই জানে। তোমার পায়ের বুটজোড়া খোলো। পায়ের দিকে তাকাও। সে চিরদিন ভিন্নতা। বুকে হেঁটে ঘরে ফিরে যাও। তোমার খড়ের চালে লাউডগা সাপ। লাউডগায় খুলে রাখো চোখ আর পাপ।

 

১৩ মার্চ ২০০৯ রাত ১২:৪৯

কেনো বসে থাকি এই নিস্তাপ টেবিলে? চোখের ছুরিতে দৃশ্যগুলি চিরে দেখি। ডানপাশের হাওয়া ভেঙে বাঁপাশে সাজাই। কুকুরের চোখে বিহ্বল তন্দ্রা নামে। বিড়ালের চোখে বিহ্বল তন্দ্রা নামে। আমার চোখেও। ছায়ারা প্রলম্বিত হয়ে ক্রমে লুট করে রাস্তা। এই কাক এই উপবন বিস্তারিত বর্জ্য। ঘুমঘুম ঘ্রাণ ছিঁড়ে যেতে চাই। কে তবে গন্ধের উৎস সন্ধান করে। কে বসে থাকে এই নিস্তাপ টেবিলে। দূরে বসে বিলাপিত বয়েসী মাতাল। প্লাটফর্ম ছেড়ে চুপচাপ নেমে পড়ি। বুকপকেটে দুপাটি রেললাইন নিয়ে ফিরি। আমার নিঃশব্দ ট্রেন আসবে। আমার নিঃশব্দ ট্রেন আসবে।

মঞ্জুভাই : তীব্রতা দুর্লক্ষ্য নয়। দুষ্প্রবেশ্য নয়। Incompatibility বা Inconsistency তে ছায়া-সূত্র তৈরি হয়। তেজাব-তীব্রতা এড়িয়ে স্নিগ্ধ। সর্বসন্তু সুখি ন। মঙ্গলার্থে…

 

৪ জানুয়ারি ২০০৯ রাত ১:১৮

আমি : দূরে তাকাও একটু দূরে। একটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে শান্ত চোখ। তাকে কি চাইলেই ছুঁতে পারো? থামো, বোকামি করো না। এইপথ কেবল সেই জানে। তোমার পায়ের বুটজোড়া খোলো। পায়ের দিকে তাকাও। সে চিরদিন ভিন্নতা। বুকে হেঁটে ঘরে ফিরে যাও। তোমার খড়ের চালে লাউডগা সাপ। লাউডগায় খুলে রাখো চোখ আর পাপ।

মঞ্জুভাই : উড়ালপন্হে গৃহ ভ্রমণ করে গেলাম। কোথাও কি রেখে গেলাম ডানার কম্পন…। ছবি নেই কেন? দৃষ্টিনন্দন তো ছিল…

আমি : হ্যাঁ, রেখে গেলেন; অন্যকোনো কম্পনে। অন্ধকার সবচে’ বেশি দৃষ্টিনন্দন। অন্ধকারে চোখ রেখে কেউ কি অন্ধকারেই কিছু খুঁজে? যে চায় সেতো খুঁজে বুকের ভিতর। আপনি যদি চান, আমি কবি হই; তবে আমার লেখার অসংগতিগুলি ধরিয়ে দিবেন। আমার অহম পরিমিত।

মঞ্জুভাই : প্রত্যাখ্যাত। বরণ করি ঈশ্বরের সাজা। মহারাষ্ট্রে তাই আমি শয়তানের রাজা। প্রথম যখন পাঠ করি মনে হচ্ছিল অসংগতিগুলো আরো তীব্র হবে, আর তখনই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে বাইনারি অপজিশান বা যুগ্ম বৈপরীত্য। আপনার এই কবিতায় মিস্ত্রিবিদ্যার চেয়ে কবিতা অনেক। অন্ধকারে মাঝে মাঝে দেখা যায় আলোর আকৃতি। দৃশ্যমান অহম। তীব্র তরুণ।

আমি : অন্ধকার হলো স্বপ্ন আর কল্পনার দুয়ার।

 

১৪ জানুয়ারি ২০০৯ রাত ২:৫১

আমি : বিস্তারিত গতকাল নামিয়েছে শরীরে ঘুঘুসুর ধস। ক্ষয়পাশ আঁতিপাঁতি খুঁজে পূর্বাপর রুহিতন করুণ। বেগুনি সুতোতে জোনাক গেঁথেছে জন্মান্ধ চোখ। ঘর উঠান আর পাহাড়ের ওপার জেগেই থাকে। ভাঁটফুল ক্ষেত উল্লম্ব দিগন্তচুর হয়েছে লাল অসুখ। একটি আপেল গাছের ডালে বসে দুটি শাদা কাক আচঞ্চু চুম্বনে বাজিয়েছে রাতে দীর্ঘ রাতের শাঁখ।

মঞ্জুভাই : ঘন এবং অতি শুভ্র বনভূমে আমিও কি রোপন করি অক্ষরের কবর? আমিও কি তবে কবিতা লিখি!
আমি : আস্তিনে চিলের পালক রেখেছি লুকিয়ে।

শেষ রাতে মঞ্জুভাইকে স্বপ্নে দেখলাম। ঠিক দেখলাম বলা যাবে না। স্বপ্নে দেখলাম আমি ঘুম যাচ্ছিলাম, আর তখন একটা ফোন এলো +৪৪৭৮৩৪১৯৫২৩৩ এই নম্বর থেকে। এটা মঞ্জুভাইয়ের দ্বিতীয় ফোন নম্বর। তাকে স্বপ্ন দেখার প্রধান কারণ বলে আমার মনে হয়, এই প্রথম রক্তের সম্পর্কের বাইরের কারো মৃত্যুতে আমার ভয়ানক কষ্ট হয়েছে। মনে হচ্ছে এই ক্ষতি পুরনের ক্ষমতা আর প্রকৃতির নাই। তো ফোন ধরার পর আমাদের মধ্যে কথা হলো নিম্নরূপ :

মঞ্জুভাই : হ্যালো নির্ঝর, আমি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু।

আমি : জি, মঞ্জুভাই বলেন। কিন্তু আপনি আমাকে ফোন কেমনে করতেছেন? আপনি তো মরে গেছেন। আজকে তো আপনার কবরে থাকার কথা।

মঞ্জুভাই : কবর থেকেই ফোন দিলাম, নির্ঝর। কী ঝামেলায় পড়লাম বলেন তো! এরা আমার কফিনটা মনে হয় ছোটো বানিয়েছে। পা মুড়ে শুয়ে আছি, এপাশওপাশও করতে পারছি না। পা টেনে চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছে করছে। পারছি না।

আমি : মঞ্জুভাই, আপনি কফিনটাকে মায়ের গর্ভের মতো মনে করে নেন, তাহলে আর অস্বস্তি লাগবে না। মায়ের গর্ভের ভিতর তো শিশুরা এইভাবে কুণ্ডলী পাকিয়েই থাকে। আর মানুষ মরে গেলে তো শিশুর মতোই হয়ে যায়।

মঞ্জুভাই : হো হো হো, ভালো বলেছেন তো! কিন্তু নির্ঝর সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়…

আমি : আপনি সমস্যা বলার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। আপনি কবরের মধ্যে ফোন পাইলেন কই?

‘মঞ্জুভাইতো চাইতো উনার কবর দেশে হবে, আমাকে অনেকবার বলেছে। তার অনেক লেখাপত্রেও আছে। দেশে উনার মা এখনো জীবিত। কিন্তু হইতেছে না। মানুষ আসলে অন্য মানুষের মন বুঝে না, নিজের যন্ত্রণাটাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। দেখেন, হুমায়ুন আজাদের মনও কেউ বুঝেনি।’

মঞ্জুভাই : কফিন বন্ধ করার সময় দানিয়েল চুরি করে কফিনের ভিতর আমার ফোনটা আর একটা টেকিলার বোতল দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বেটা ভুল করে গোল্ড দিয়ে দিয়েছে, আমি খাই ব্ল্যাঙ্কো। সে যাইহোক সমস্যা হচ্ছে বোতলের মুখটা খুলতে পারছি না ঠিকমতো হাত নড়াচড়া করতে পারছি না বলে।

আমি : মদ খাবেন আবার? অবশ্য এখন খেলেই বা কি! এখন তো আর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তো এখন আপনার দুঃখ কী?

মঞ্জুভাই : ভিনদেশি মাটির গন্ধ ভালো লাগছে না। ভেবেছিলাম মৃত্যুর পর মায়ের কাছাকাছি যাবো। নিজের মাটিতে যাবো, হলো না। কেউ আমার মন বুঝলো না। মা তো আমার পথ চেয়েই ছিলো। (মঞ্জুভাইয়ের গলা কাঁপছে মনে হলো)।

আমি : আপনি কফিনের ডালাটা ঠেলে ওপরের দিকে একটু আলগা করতে পারেন কিনা দেখেন। এখনো মাটি নরম আছে। তারওপর বৃষ্টি হইছে। আপনি কিলবিল সিনেমায় উমা থারম্যানের কফিন থেকে বের হবার সিন মনে করেন…

এরপর লাইন কেটে গেলো। আমার ঘুমও ভেঙে গেলো। এই স্বপ্নে মাঝখানে আরো কিছু কথা ছিলো মনে করতে পারছি না। এই স্বপ্ন দেখার কারণ হচ্ছে গতকাল মঞ্জুভাইকে কবর দেয়া হয়েছে। আর তাকে কবর দেয়ার বিষয়ে বুননের সম্পাদক কবি খালেদ উদ-দীনের সঙ্গে পরশুদিন কথাও হচ্ছিলো। বলছিলাম, ‘মঞ্জুভাইতো চাইতো উনার কবর দেশে হবে, আমাকে অনেকবার বলেছে। তার অনেক লেখাপত্রেও আছে। দেশে উনার মা এখনো জীবিত। কিন্তু হইতেছে না। মানুষ আসলে অন্য মানুষের মন বুঝে না, নিজের যন্ত্রণাটাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। দেখেন, হুমায়ুন আজাদের মনও কেউ বুঝেনি।’ এই স্বপ্ন দেখার আরেকটা কারণ হলো, আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করেছি মঞ্জুভাই স্মরণে গলা অবধি টেকিলা খাবো। আরেকটা কারণ হচ্ছে মঞ্জুভাইয়ের একটা কবিতার লাইন, খুব সম্ভবত তার ‘সাপ ও সূর্যমুখী’ বইটাতে আছে। সেই লাইনটা কদিন ধরে মাথার মধ্যে ঘুরছিলো, ‘ আমার শবদেহ কি দীর্ঘ মনে হচ্ছে তোমাদের কফিনের মাপে!

তো সব মিলিয়ে আমার আনকসাস এই স্বপ্ন তৈরি করেছে। আশা রাখছি, আমার এই স্বপ্ন কারো পবিত্র অনুভূতিতে আঘাত করবে না।

bottom of page