top of page

কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু

 

খালেদ উদ-দীন

 

 

কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৯৭০, মাতৃমঙ্গল, সিলেট। মৃত্যু ১৭ নভেম্বর ২০১৮, যুক্তরাজ্য। মূলত কবি তিনি। পাশাপাশি কথাসাহিত্যিক, গদ্যকার, ক্রিটিক। অনিয়মিতভাবে সম্পাদনা করেছেন চিন্তা ও চিন্তকের একটি ছোটকাগজ ‘ধীস্বর’। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০-এর অধিক। আটটি কাব্যগ্রন্থের সংকলন ‘বিদ্যুতের বাগান সমগ্র’ নামে এক মলাটে মুদ্রিত। প্রকাশিত দুটি উপন্যাস—‘কাফের’ এবং ‘জ্যোৎস্নার বেড়াল’।

মাত্র ৪৮ বছর বয়সে রোববার (১৮ নভেম্বর ২০১৮) হঠাৎ করেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন একজন প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফুর্ত মানুষ কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু। ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন।

কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু হলেন এ সময়ের শক্তিমান ও প্রভাবশালী কবিদের একজন। দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু ছিলেন মূলত কবি। পাশাপাশি তিনি কথাসাহিত্যিক, গদ্যকার, ক্রিটিক, দর্শন-ভাষ্যকার। তাঁর কবিতা থেকে গানও সৃষ্টি হয়েছে। তিনি অনিয়মিতভাবে সম্পাদনা করেছেন চিন্তা ও চিন্তকের একটি ছোটোকাগজ নাম ‘ধীস্বর’। তার গ্রন্থসংখ্যা ১০-এর অধিক। তাঁর আটটি কাব্যগ্রন্থের সংকলন এক মলাটে ‘বিদ্যুতের বাগান সমগ্র’ নামে পাওয়া যায়। তাঁর প্রকাশিত দুইটি উপন্যাস ‘কাফের’ এবং ‘জ্যোৎস্নার বেড়াল’ আমাদের অন্য এক পোয়েটিক-ফিকশনের জগতে নিয়ে যায়। এছাড়া তাঁর আরো প্রায় দশটা পাণ্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায়।

তাঁর প্রকাশিত বইগুলো হলো : ইস্পাতের গোলাপ (২০০২), ঈসাপাখি বেদনা ফোটে মরিয়মবনে (২০০৪), মৌলিক ময়ূর (২০০৬), নীল কাব্যের বয়াত (২০০৭), জ্যোৎস্নার বেড়াল (২০০৭), সাপ ও সূর্যমুখী (২০০৮), বিদ্যুতের বাগান (২০১০), অভিজিত কুণ্ডর লায়ন লিলিগুচ্ছ(২০১১), বিপুলা বীজগণিত (২০১২), বিদ্যুতের বাগানসমগ্র (২০১৩), ও দক্ষিণামৃত (২০১৫)।তাঁর জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর, বাংলাদেশের সিলেট জেলার মাতৃমঙ্গলে। আর পৈতৃক নিবাস সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের আগ্নপাড়া গ্রামে।

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু, সেই কবি যিনি সততাই বলে থাকেন যে ‘একজন্মে মানুষ কবিতা লিখতে পারে না, মানুষ কবিতা লিখে মৃত্যুর পরে।’ এই ভাব-বাক্যের সম্প্রসারণ আসলে একটা দীঘল পুস্তকের ধারণের ক্ষমতা আছে বলেও আমি সংশয় করি। আমি চমকে উঠি যখন তিনি বলেন, ‘নারীর রক্তে রোদ লাগবে, ধীরে তা দুধ হয়ে যাবে’ কিংবা যখন বলেন, ‘হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাবে চাঁদ’ এই জাতীয় কথা। জীবনদাশের পরে যেকজন কবি স্বকীয় স্বর বা নিজস্ব স্টাইল দাঁড় করিয়েছেন বাঙলা কবিতায় তিনি নিঃসন্দেহে তাদের একজন। হাজার কবিতার ভিতর নাম মুছে দিয়ে তাঁর কবিতা ছেড়েও দিলেও তার নামেই জ্বল জ্বল করবে সেই কবিতা।

কবির অন্য নাম কালেশ্বর। দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুকে কালেশ্বর রূপে ধারণ করতে হলে তাঁর কাব্যস্থিত তড়পে-ওঠা তরুর ক্রন্দন অনুধাবন করা জরুরী। তাঁর মতে, কবিতা হচ্ছে অগ্রন্থিত আয়ুর বর্ণনা এবং ধ্যানের সর্বোচ্চ ধ্রুপদ যা গভীর ভাষা ও গহন আঙ্গিকে বিকৃত। কাব্যকাল চিহ্নিতকরণের জন্য এই কবিকে নব্বইদশকের কবি বলা হলেও তার শক্তিকে অবদ্ধ করা যাবে না কোনও দশকের নর্দমায়।

বিশেষ কাউকে অনুকরণ বা অনুসরণ করে এই কবির জন্ম হয়নি। ইনি উদ্ভিদের মতো ভূমি থেকেই অজানিত বৃক্ষরূপে উদ্গত হয়ে বিস্তারিত হয়েছেন আপন নামে। তিনি জীবনের প্রয়োজনে দীর্ঘদিন রাশিয়ার মস্কোতে ঘুরাঘুরি করে-টরে জীবন ও জীবিকার এক পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে চলে যান। আর সেখানে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বসবাসের পরও তাঁর কবিতা হয়ে উঠেনি বিদেশি কবিতা।

13413031_10154321003633442_8083784752523

তাঁর কবিতায় সবসময়ই ছিল এই অঞ্চলের কনটেস্টে বাহিত রতি-রক্ত-মদ, জঙ্গল-জলা, নদী, হাওড় ও হাওয়ার শৃঙ্গারসমগ্র পাঠকের জ্ঞানকে মথিত করে, মূদ্রিত করে। তিনি যেহেতু কয়েকযুগ ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করেছেন, প্রচারবিমুখ বা কীভাবে নিজেকে প্রচার করতে হয় সেটা তিনি জানেন না, আর সাহিত্যক্ষেত্রে যেহেতু তাঁর কোনও উম্মতবেষ্টনি নেই যেহেতু তাঁকে অনেকেই পড়েননি বা সেইভাবে পড়ার সুযোগ পাননি। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো তাঁর সমসাময়িক বড় বড়(?), খ্যাতিমান, পুরস্কারধারী, লিটলম্যাগের সম্পাদক, সাহিত্য-সম্পাদক বন্ধুরাও তার লেখা চেয়ে নেন না, বা তার সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না বা বলতে চান না। এর একমাত্র কারণ আমার মনে হয় ঈর্ষাপ্রসূত ভয়।

কবির অন্য নাম কালেশ্বর। দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুকে কালেশ্বর রূপে ধারণ করতে হলে তাঁর কাব্যস্থিত তড়পে-ওঠা তরুর ক্রন্দন অনুধাবন করা জরুরী। তাঁর মতে, কবিতা হচ্ছে অগ্রন্থিত আয়ুর বর্ণনা এবং ধ্যানের সর্বোচ্চ ধ্রুপদ যা গভীর ভাষা ও গহন আঙ্গিকে বিকৃত। কাব্যকাল চিহ্নিতকরণের জন্য এই কবিকে নব্বইদশকের কবি বলা হলেও তার শক্তিকে অবদ্ধ করা যাবে না কোনও দশকের নর্দমায়। আমি তাকে দশকোত্তীর্ণ বা অনন্তদশকের বলে কবি জ্ঞান করি। যিনি সর্বগ্রাসী, মেঘের উর্ধ্বতন যিনি দীর্ঘ হাঁটেন তিনি কোনো মাস, বছর, কালের কবি নন; অখণ্ড সময়ের কবি। তিনিই সংযোগ ঘটাতে পারেন কবিতার সঙ্গে গর্হিত আত্মহত্যার অথবা ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার। কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু হলেন এ সময়ের শক্তিমান ও প্রভাবশালী কবিদের একজন।

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু তাঁর লেখা ‘ক্যান্সার আক্রান্ত কবিতা’র মতো সেই কঠিন ব্যাধির কাছেই যেন হার মানলেন।

  • আজ নগর-বার্মিংহামে রোদ উঠেছে
    আমি বলছি না আজ প্রিয়জনের রক্তে রোদ লাগবে
    ধীরে তা দুধ হয়ে যাবে…
    বরং কোথাও না কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে
    যাচ্ছি
    যাচ্ছি
    যাচ্ছি
    একা একা যাচ্ছি আমার যানাজায়’
    ‘অনেক অনেক দিন পর বার্মিংহামের আকাশে রোদ উঠেছে
    মনে হচ্ছে, এখনো মরি নি
    প্রিয় দক্ষিণ, হাড়ের অন্ধকারে নিভৃতে বহে
    আগুন বাহিত চর্বি ও আঙুর ফলের নদীনালা’।।

bottom of page