top of page
36461271_10156661189043442_2551622160539
কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু
আগ্নপাড়ার অগ্নিফুল
সারওয়ার-ই আলম
সাহিত্যের অনতিক্রম্য উচ্চতায় পরিভ্রমণের অদম্য আগ্রহ কাব্য চর্চার একেবারে শুরু থেকেই পরিলক্ষিত হয় কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর কবিতায়।
নিজস্ব সৃষ্টিকে প্রথাগত চর্চার ঊর্ধ্বে  স্থান দেয়ার প্রয়াসে কবি সবসময় নিজেকে ব্যাকরণ কাঠামোয় আবদ্ধ রাখতে চান নি; স্বীয় অনুভূতির স্ফুরণকে খুঁজে দিয়েছেন মুক্তাকাশ, সুযোগ করে দিয়েছেন বুক ভরে শ্বাস নেয়ার।
কবি বিরামহীন প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেছেন বিপুল ব্যন্জনাধর্মী নতুন নতুন চিত্রকল্প, সাফল্যের মুকুটে যুক্ত করেছেন একেকটি হীরকখণ্ড; যে কারণে সমসাময়িক কবিদের তুলনায় তিনি আলাদা। তার কবিতা একেবারে ভিন্ন মেজাজের, ভিন্ন আঙ্গিকের। কবির চিত্রকল্পগুলো  ঘাতে সহনীয় কিন্তু প্রত্যাঘাতে অপ্রতিরোধ্য, আলাপে মিশুক কিন্তু অবয়ব কাঠামোয় দুর্ভেদ্য। কবি প্রকৃতঅর্থেই স্বকৃত স্বত:ন্তর।

আগ্নপাড়ার অগ্নিফুল কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর কবিতার প্রধান সৌন্দর্য স্বনির্মিত চিত্রকল্প, যা একদিকে যেমন নান্দনিক অন্যদিকে অভূতপূর্ব । ভাবনার গভীর গহিনে ডুব দিয়ে ভিন্ন স্বাদের শালুক তুলে আনার তাঁর  যে ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা তা অনুসন্ধানী পাঠক উপভোগ করেন বলেই তাঁর কবিতা তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছে এক অনন্য উচ্চতায়।’ইস্পাতের গোলাপ’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের মহাসড়কে কবির যাত্রা শুরু।এ গ্রন্থের নাম শিরোনামের কবিতাটিতে কবি বলছেন-
কর্ষিত
কর্ষিত রুহের জমিন 
ধর্ষিতার জরায়ুতে বাড়ে পবিত্র পাপ
দশমাস দশ দিনে ফোটে ইস্পাতের গোলাপ।
 
কবি চিত্তে প্রোথিত অভিব্যক্তির কী অসাধারণ প্রকাশ! অনুশীলনপর্ব থেকে শুরু করে প্রথমদিককার কবিতাগুলোতে আমরা লক্ষ্য করি কবি বেশ সতর্কভাবেই অগ্রসরমান এবং সুনিপুণ শৈল্পিক সৃষ্টিতে নিবিষ্ট। ইস্পাতের গোলাপ কাব্যগ্রন্থে ব্যবহৃত অন্যান্য চিত্রকল্প, যেমন- ‘মগজের পুঁজ’, ‘তামাটে বরফ’, ‘হাহাশ্বাস’, ‘অন্ধপ্রজাপতি’, ‘শহরের নাভি’, ‘কাচের ঘোড়া’, ‘নরোম পাপ’, ‘রেশমি গুনাহ’, ‘অশুদ্ধ পূর্ণিমা’,’ গ্রিনিচ গুহা’, ‘নক্ষত্র পেরেক’, ‘তকতার মগজ’ প্রভৃতিতে কবির অনুসন্ধিৎসু মনের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। কবিতা পাঠে অনুমিত হয় এসকল চিত্রকল্প যতোটা না তাঁর সচেষ্ট নির্মাণ তার চেয়ে বেশী তাঁর কাব্যমনীষার সপ্রণোদিত উদগীরণ; যা কিনা কবির সুকুমার মনের অলিন্দে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় যূথবদ্ধ ছিল। 

সৃষ্টির অনিবার্য আকাঙ্ক্ষায় কবি ছিলেন সদা উন্মুখ। প্রথাগত বৃত্ত ও অনুপ্রাসের দাসত্ব না করা এ আপোষহীন কবি ছিলেন ভিন্নস্রোতে ধাবমান, গতিশীল ও লক্ষ্যভেদী, ধীমান ও প্রথাবিরোধী।কবি বলছেন-
মানুষ কি মানে নাক্ষত্রিক শাসন
দৈবাৎ আলোর বৃন্ত!
ভ্রূক্ষেপ নেই
শব্দাহত নৈ:শব্দ্য নির্মাণে
পৃথিবীর সব শিল্পকলা.....

সৃষ্টির আদি থেকে সৌরজগৎ  যে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে পরিচালিত সে তো মহাবিশ্বের মহানিয়ম ছাড়া আর কিছুই নয়, নিয়মতান্ত্রিক কিন্তু বৈচিত্রহীন! কবির সহজাত সৃষ্টিশীল মন তা মেনে নিতে অনিচ্ছুক। কবি মন ঝর্ণার মতো উচ্ছল, তীব্র প্রাণোচ্ছ্বাসে বেগবান, বল্গাহারা। তাকে কী নিয়মের অধীন করা যায়? নিশ্চয় নয়! বোধকরি এরকম অনুভূতি থেকেই কবি বলছেন-
আমি স্বয়ংভূ, সনাতন, শব্দ
নৈ:শব্দ জীবনেশ্বর
আমি
আমি
আমিশ্বর।

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে (ঈসাপাখি বেদনা ফোটে মরিয়ম বনে) কবিকে লক্ষ্য করি আত্ম- অনুসন্ধানে মনযোগী হতে। এ পর্যায়ের কবিতাগুলোতে স্মৃতিকাতরতা, নৈ:শব্দের প্রতি মোহাবিষ্টতা কবির ভাবনার আঙিনায় ‘এলাচির জাহাজ’রূপে বাতিঘরের সন্ধানে যাত্রারত। বিমূর্ত কাব্য ভাবনা থেকে কবি ধাবিত হতে থাকেন উৎসমূলের সন্ধানে। তাঁর বহুবর্ণিল কাব্য-ভাবনার ফেনিল স্রোতধারা যেন কিছুটা গতি হারায়, হয়ে উঠে  নিষ্প্রাণ। কবিকে বলতে দেখি-
প্রাণের গহনে সন্ধ্যা আসেরে পাখি
বাতাসে ছাই হয়ে ভাসি 
হাড়ের অন্ধকারে তোমারে মায়া করে রাখি।
দুপুর হুলস্থূল শেষে
বিরুন ধানের ক্ষেতে নারকেলের ছায়ায় শুয়ে থাকি
অন্তে, শীতলে। ক্লান্ত লাগেরে পাখি
উড়াল ডানা দিয়ে ধরে আনি না আর
বড় রোদের মাছ
তোমার গেন্ডাফুলের দুই চোখে
ডুবিয়ে ফেলি এলাচির জাহাজ।

এ সময়কার কবিতাগুলোতে কবির স্বপ্নভঙ্গের বেদনা স্পষ্ট। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেকটা ক্লান্ত, দ্বিধান্বিত কবি প্রিয় কাব্য-ভাবনাগুলো ‘হাড়ের অন্ধকারে মায়া করে’ রেখে দেন, কখনো স্বেচ্ছায় আবার কখনোবা অভিমানী অনিচ্ছায় ডুবিয়ে দেন ‘এলাচির জাহাজ’। আমরা বঞ্চিত হই সময়ের সুগন্ধ কিংবা জাদুবাস্তবতার উপঢৌকন থেকে।  বিরুদ্ধ সময়ের যাত্রী কবির মানসপটে স্থির দণ্ডায়মান হয় ঝজ্ঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জীবনের সমূহ সংকট। নিরবচ্ছিন্ন সৃষ্টিতে আসে প্রতিবন্ধকতা। জীবনের বাস্তবতা তাঁকে মুখোমুখি করে এমন এক সময়ের যখন কবি ভাবেন-
বাড়ি ফিরি না
বাড়ি খেয়েছে ইঁদুরে। তাই
আর নাই কোরক সমুদ্রমুদ্রিত। রাক-শশী বলে কে তুমি?
হাতে বৈঠা ঘাটে নাও, মঞ্জু বেপারী।

স্বপ্ন ও সম্ভাবনার দোলাচলে দুলতে থাকা কবি এ সময় রচনা করেন ‘প্রানপদ্য’, যেখানে সুদিনের আকাঙ্ক্ষায় কবি ‘আগরগাছ’গুলোকে রেখে দেন পরম যত্নে ভবিষ্যতের কোন এক সোনালি সময়ের আশায়। কবির ভাষায়-
....পৃথিবী মরিয়া যায়
পৃথিবীর ধড় রাখিয়া দিয়ো লালনের বুকে

আত্মবিশ্বাসী কবি বোধকরি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন- লালনের সংগীত-বর্ধিষ্ণু বুক প্রাণোচ্ছ্বাসে এতোটাই ভরপুর যে সেখান থেকে মৃত পৃথিবীও জেগে উঠতে পারে নব নব প্রাণের বন্যায়, জেগে উঠতে পারে নতুন কিশলয়।

দু:সময় বেশীদিন কবিকে পরাস্ত করতে পারে না। ‘ছায়া ও স্রোতের তাড়ায়’ কবি আবারো ‘চন্দ্রশিকারী’ হয়ে ওঠেন ‘ নীল কাব্যের বয়াতে’। কবি বলেন-
হে সূর্য, অসীম অক্ষর ঢেলে দাও বাতাসের জলে
ছায়া ও স্রোতের তাড়ায় চন্দ্রশিকারী দূরতম যায়।

পরবর্তীতে ‘মৌলিক ময়ূর’ গ্রন্থের কবিতাগুলোত প্রতীয়মান হয় কবি প্রত্যাবর্তন করছেন অযুত নিযুত সাফল্য নিয়ে। নির্মাণশৈলী আর কাব্য-কাঠামোয় আমরা কবিকে এক ধরনের জাদুবাস্তবতায় ও  নৈর্ব্যক্তিক  ভাবনায় আবিষ্ট হতে দেখি। কবি বলছেন-
স্থপতি পিঁপড়ার ডালে
পেখম মেলেছি বন্ধু
পাথরে, নাসারন্ধ্রে দুলে মৌলিক বাতাস
এ রাগ ভাসমান আনন্দ আলোয়।
......এ আমার ঘোর
সজ্ঞানে নৃত্যরত-আলো, আবর্জনা
মহাকালে কান্না করে মৌলিক ময়ূর।

স্থপতি পিঁপড়ার ডালে পেখম মেলা এক নিরলস কর্মব্যস্ত কবিতা-কারিগর কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু মূলত একজন স্বভাব কবি। কাব্যচর্চায় ‘মৌলিক ময়ূর’ পর্বে কবি মনোনিবেশ করেন অভিনব সব চিত্রকল্প নির্মাণে।অর্থের গভীরতা আর বিষয়সংশ্লিষ্ট শব্দ বিন্যাসের নান্দনিক আয়োজনে তাঁর প্রায় প্রতিটি চিত্রকল্পই অপ্রতিদ্বন্দ্বী।পরবর্তী একযুগ সৃষ্টির ধারাবাহিক কর্মযজ্ঞে কবি যেন নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেন।এ সময় তাঁর নির্মিত চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে ‘ সম্ভ্রান্ত শূকর’, ‘রক্ত কবুতর’, ‘ধূসর পায়রা’, ‘লোহার নগরী’, ‘তরল প্রজাপতি’, ‘কুয়াশার কংকাল’, ‘দুধের মাংস’, ‘সবুজ কুকুর’, ‘জলের মাংস’, ‘পিঁপড়ার ডাল’, ‘ঘাসের দালান’, ‘দুধের কাটা’, ‘মেঘের কলিজা’, ‘ঘাড় ভাঙ্গা গোলাপ’ প্রভৃতি প্রণিধানযোগ্য। চিত্রকল্পের এই কারিগর সমসাময়িক অন্য কবিদের তুলনায় স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত। 
আত্মনির্মাণের প্রায় প্রতিটি পর্বে আমরা কবিতার এমন একজন মিস্ত্রীকে খুঁজে পাই যিনি তাঁর সৃষ্টিকে ছন্দ-মাধুর্যের সুলতানে সীমাবদ্ধ না থেকে শব্দের আলোকরশ্মি প্রক্ষেপণ করেছেন এমন এক দর্পণের যাতে প্রতিফলিত প্রতিটি বিম্বই তাঁর নিজস্ব। তাঁর গতিশীল ভাষা অসাধারণ কাব্য সুষমায় সমৃদ্ধ, আধুনিক বাংলা কবিতার আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জের মতো দ্যুতিময়।নিজস্ব এ বিনির্মাণ সম্পর্কে কবি বলছেন-
আমি মূলত: কবিতা লিখি না
লোহার ভিতরে তৈরি করি তুলোর গর্ত

‘লোহার ভিতর তুলোর গর্ত’- কি অনন্য ভাবনা! কী যাদুময় চিত্রকল্প! কবির এ বিশুদ্ধ ভাবনা জানান দেয় কী নেশায় তিনি মেতেছিলেন একটি স্বতন্ত্র কাব্যধারা নির্মাণের আকাঙ্ক্ষায়!

চিত্রকল্পের এই যাদুকর মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে গত ১৭ নভেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে যান ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। এ ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বেনারসিতে তিনি যে নৈপুণ্যের সংযোগ ঘটিয়েছেন তার সে প্রকীর্তি নি:সন্দেহে দীপ্তি ছড়াবে যুগের পর যুগ। অকাল প্রয়াত কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু বেঁচে থাকুন তাঁর কর্ম ঐশ্বর্যে আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে। চিরায়ুষ্মান হোক তাঁর কবিতা!

 
bottom of page