top of page

দেলোয়ার হোসেন  মঞ্জু:

এক আত্মঘাতী কবির প্রতিকৃতি-১ 

 

 

আবু মকসুদ 


দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু গত হয়েছেন মাস পাচেক হয়ে গেছে, তাঁকে নিয়ে শোক কিংবা তাঁর সৃজনী নিয়ে উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে যাওয়ার কথা । কিন্তু তা হচ্ছে না, যত দিন যাচ্ছে মঞ্জুর ভুত আর বেশী করে জাঁকিয়ে বসছে তাঁকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না।

 

এমন না যে জীবিত কালে তিনি খুব উচ্চারিত ব্যক্তি ছিলেন বরং বিপরীত, তিনি তাঁর বলয়ের বাইরে খুব একটা আলোচিত হতেন না। তবু এখন কেন তিনি আড়ালে যাচ্ছেন না, কেন তাঁকে স্মরণ অন্তে যাপিত জীবনে প্রত্যাবর্তন করা যাচ্ছে না! কেন তিনি বারবার মননে হানা দিচ্ছেন, কেন তাঁর চিৎকার কর্ণ বিদীর্ণ করে পারে আছড়ে পরছে! কেন বারবার স্মরণ পারে তিনি বলছেন আমি ছিলাম, আমি থেকে যাবো! কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় তিনি কখনোই তাঁর বলয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর বিস্তার ছিল সর্বব্যাপী। বিলেতের সব সাহিত্য আসরে, আড্ডায়, উৎসবে, পার্বণে তিনি ছিলেন। বিলেতের সাহিত্য পাড়ার সাথে তাঁর তেমন কোন সংযোগ ছিল না, সম্ভব হলে এসব তিনি এড়িয়ে চলতেন।

36478220_10156659924518442_3483632632162

তিনি বলতেন এসবে কিচ্ছু হয় না, মূর্খদের আড্ডা, অনুষ্ঠান, উৎসবে সাহিত্যের বিন্দুমাত্র ফায়দা হয় না। তবু বিলেতের কোন অনুষ্ঠান তাঁকে ছাড়া অপূর্ণ থেকে যেতো। যদি ভাগ্যগুণে তিনি উপস্থিত হতেন যেকোনো অনুষ্ঠান ভিন্ন মাত্রা পেতে। তাঁর উপস্থিতি আয়োজকদের বাড়তি চাপে ফেলতো, আয়োজকরা আপ্রাণ চেষ্টা করতেন ভাল এবং নান্দনিক অনুষ্ঠান উপহার দিতে।

 

তাঁকে কেউ অস্বীকার করতে পারতো না, ধারালো মুখের জন্য প্রকাশ্যে অপ্রিয় হলেও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব কেউ মাড়িয়ে যেতে পারত না। প্রকাশ্যে যারা নাম নিতে দ্বিধা করতো গোপনে কিংবা অপ্রকাশ্যে তাঁকে পড়তে হুমড়ি খেয়ে পরতো। 

 

বিলেত পাড়ায় অনেকেই তাঁকে সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলতো। তাঁর সঙ্গ, কথাবার্তা অনেকের পছন্দ হতো না। তিনি নিজেকে ছাড়া সবাইকে অল্প মেধার মনে করতেন। এখানে কোন সাহিত্য হয় না, কাগজ হয় না। এখানকার সম্পাদকরা সম্পাদনার কিছু জানে না, যারা ছোট কাগজ করছে বলে দাবী করে তারা জানেই না ছোট কাগজ কি। ছোট কাগজের সম্পাদকদের তিনি সম্পাদক না বলে সংকলক বলতেন, বলতেন এরা ভাল করে সংকলনও করতে পারে না। এখানের পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতাকে তিনি রঙিন আবর্জনা হিসাবে চিহ্নিত করতেন। তিনি মনে করতেন সাহিত্য বিশুদ্ধ হতে হবে, আবর্জনা মুক্ত হতে হবে। তিনি মৌলবাদকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন, মৌলবাদের সাথে কারো সামান্য সম্পৃক্ততা থাকলে তিনি তাকে বর্জন করতেন। 

 

হুমায়ুন আজাদের কর্মকাণ্ড তাঁর খুব পছন্দের ছিল। হুমায়ূন আজাদের সাহিত্য কর্মকে তিনি প্রকৃত সাহিত্য কর্ম মনে করতেন। ''পাকসার জমিন সাদবাদ'' নিয়ে আমাদের আপত্তির বিপরীতেও তাঁকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখেছি। তাঁর মতে মৌলবাদীদের চিত্রায়ন যেভাবে হওয়া উচিৎ হুমায়ূন আজাদ ঠিক সেভাবেই তাদের চিহ্নিত করেছেন। তাদের চিহ্নিত করনে এরচেয়ে শুদ্ধ ভাষা আর হতে পারে না। আল মাহমুদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিপরীতে কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে তাঁর আপত্তি ছিল। তাঁর মতে একজন মৌলবাদী কোনভাবেই কবি হতে পারে না, আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদকে অন্তর্ভুক্ত না করে হুমায়ূন আজাদ সঠিক কাজই করেছেন। 

 

তিনি বলতেন জীবনে একটা কবিতা লিখলেই হবে, হাজার হাজার অনর্থক কবিতা প্রসবের কোন মানে হয় না। দিস্তা দিস্তা বই ছাপিয়ে কি লাভ যদি না একটা পঙক্তি লোকের মনে থাকে। আবার বলতেন লোকের মন যুগিয়ে যারা লেখার চিন্তা করে তারা নিম্ন মেধার, আপনাকে আপনার যুগের চেয়ে অগ্রসর হতে হবে। আপনার মৃত্যুর বহুবছর পরে কেউ যদি এক পঙক্তি পড়ে জেগে উঠে তবেই আপনি সার্থক। 

 

সাহিত্য নিয়ে তাঁর বিভিন্ন পরিকল্পনা ছিল, তিনি নিরীক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। প্রথাগত ছন্দের বাইরে গিয়ে কবিতা লিখতে প্রায়ই উৎসাহ দিতেন। তাঁর লেখার সূচনাকালে যদিও তাঁকে প্রথার হাত ধরে চলতে হয়েছে কিন্তু যখনই চলা শিখে ফেলেছেন প্রথাকে ছুড়ে ফেলেছেন অথবা অস্বীকার করেছেন। তাঁর হাতে জন্ম হয়েছে নতুন গদ্য ভাষা, মুক্ত গদ্যের ভুবনে তিনি অনন্য। সাহিত্যের নতুন এই বিষয় তাঁর হাত ধরেই বিকশিত হয়েছে। 

 

তিনি অনুগল্প লিখেছেন, ছোটগল্প লিখেছেন কিন্তু এসব অনু কিংবা ছোটগল্প পাঠের শেষে কিছুটা দ্বিধা থেকে যায়। এসব গদ্য ধর্মী লেখাকে কি গল্প বলা যায় না এসব তাঁর প্রবর্তিত নতুন ধারার কবিতা! তাঁকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি তিনি খোলাসা করেন নি, বলেছেন আপনার যা মনে হয় তা মেনে নিয়ে পড়ুন। তাঁর কবিতা পাঠে গল্পের স্বাদ পাই, গল্পে পাই কবিতার স্বাদ।  

 

আমার সাথে তাঁর দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বন্ধুকে যেভাবে বন্ধু ভাবা যায় ঠিক সেভাবে তাঁকে ভাবতে পারি নি, তিনিও আমাকে ঠিক সেভাবে আস্তায় নিতে পারেন নি। আগেই বলেছি তিনি প্রচণ্ড মৌলবাদ বিরোধী ছিলেন। মৌলবাদের সাথে সামান্য সম্পৃক্ততা থাকলে তিনি তাঁকে বর্জন করতেন। আমার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না অর্থাৎ মৌলবাদী কি না এ বিষয়ে তাঁর খটকা ছিল। যখনই মনে হতো আমি মৌলবাদে প্রভাবিত হয়ে গেছি কথা বন্ধ করে দিতেন, ফোন করলে ধরতেন না। যোগাযোগের চেষ্টা করলে এড়িয়ে যেতেন। আবার কখনো আমার কোন লেখায় মৌলবাদ বিরোধী অনুষঙ্গ পেয়ে উচ্ছ্বাসিত হয়ে ফোন করতেন দীর্ঘদিনের অনালাপ জনিত ক্ষোভ নিমেষেই কেটে যেত। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধের কথা শোনাতেন, বিভিন্ন পরিকল্পনা কথা বলতেন। আমি উৎসাহ পেতাম। 

 

মৌলবাদ নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা আছে । আমি আমার মতো মৌলবাদকে ঘৃণা করি, আমার মতো যুদ্ধ করি। তাঁর চিন্তার সাথে নিরানব্বই শতাংশ চিন্তা মিলে যায় আরো এক অংশের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি বোঝাতেন, একটার পর একটা উদাহরণ দিতেন। মৌলবাদ যে দেশ ও জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর এটা বুঝাতে তাঁর ক্লান্তি লাগতো না। 

 

প্রায়ই তাঁর সাথে বিলেতের রঙিন আবর্জনা নিয়ে আলাপ হতো, অর্থাৎ বিলেতের সাপ্তাহিক কাগজগুলোর সাহিত্য পাতা, এতে যে কি পরিমাণ অপচয় হচ্ছে তা তাঁকে বিমর্ষ করতো। গণ্ড সম্পাদকরা কি নির্বোধের মতো রঙের অপচয় করছে তাতে তিনি কষ্ট পেতেন, বলতেন এসবের কি কোন মানে হয়। আমি আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব যুক্তি দিতাম, পরবাসে এসব যে অপচয় নয় বরং নান্দনিকতার ধারাবাহিকতা এটা বোঝাবার চেষ্টা করতাম। তিনি বিরক্ত হতেন আমার সাহিত্য রুচি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন। তাঁকে খুশি করার জন্য অনেকসময় একমত হতাম, বলতাম বাদ দিয়ে দিবো, রঙিন আবর্জনায় আর লিখবো না। এখন থেকে বিশুদ্ধ ছোট কাগজে মননিবেশ করবো। তিনি খুশি হতেন ছোট কাগজ কি, কিভাবে করা লাগে বলে যেতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। শব্দপাঠ করার প্রাক্কালে তাঁর কিছু পরামর্শই কাজে লাগিয়েছি। বেশীর ভাগই সম্ভব হয় নি, বাস্তব কারণেই হয় নি। 

 

তিনি নিজেও একটা ছোট কাগজ করেছিলেন ধীশ্বর নামে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই কাগজ কি তাঁর কাঙ্ক্ষিত কাগজ হতে পেরেছে, তিনি বললেন না আমি মাত্র এক শতাংশ কাগজ করতে পেরেছি। তবে শত শতাংশ কাগজের চেষ্টা আমি করে যাবো। দুর্ভাগ্য ধীশ্বর দ্বিতীয় সংখ্যার মুখ দেখে নি হয়তো তাঁর কাঙ্ক্ষিত লেখা পাওয়া যায় নি কিংবা এক শতাংশের বেশী মানের কিছু হচ্ছে না দেখে ধীশ্বর পর্ব বাদ দিয়েছেন।    

 

আমি কবিতা লিখতে শুরু করি বেশ দেরীতেই, ছড়াতে ছিলাম। ছড়াও যে ভাল লিখতাম তাও না। কোনদিন কবিতা লিখবো চিন্তা করি নি। হঠাৎ কবিতা ভুত আমাকে জেঁকে বসে, লিখে ফেলি কিছু কবিতা। এসব আদৌ কবিতা কি না সন্দেহ থেকে যায়, সন্দেহ এড়াতে একে ওকে ইনবক্সে কিংবা মেইলে শেয়ার করতে শুরু করি। বেশীর ভাগই পরিচিত এবং অগ্রজ শ্রদ্ধাভাজন কবি। বেশ কয়েকজন উৎসাহ জনক মন্তব্য করেন, কেউ কেউ পরামর্শ দেন আমি সবকিছু আমলে নিতে চেষ্টা করি। কবি মঞ্জুকে পাঠাই তিনি কোন সাড়া দেন না, আমি অপেক্ষা করি। না কোন সাড়া নাই। একদিন লজ্জায় মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করি, মঞ্জু ভাই আমার কবিতা কি পড়েছেন। তিনি বললেন আপনার কবিতা আমি পড়ি কবি, এর আগে আমাকে কবি বলে সম্বোধন করেন নি। আমি লজ্জায় মিইয়ে যেতে থাকি।

bottom of page