top of page

শিকড়, অনলাইন পুরনো সংখ্যায় প্রকাশিত

এক সান্ধ্য আড্ডায় লেখক, অনুবাদক ও পরিবেশবিদ দ্বিজেন শর্মা

বিশ বছর পর কি হবে, তা নিয়ে রাজনীবিদদের ভাবতে হবে

কাইয়ুম আবদুল্লাহ

Deejen Sharma3.jpg

স্মৃতির এলবামে আরেকটি দিন সংযুক্ত হলো-আড্ডার এবং আনন্দের। আনুষ্ঠানিকতা ছিলো না বটে, তবে বলা যায় ব্যতিক্রমী এক আড্ডার আয়োজন করেছিলেন কবি ইকবাল হোসেন বুলবুল। অনেকটা তা”ক্ষণিক এ আয়োজনে বিশিষ্ট লেখক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক ও পরিবেশবিদ দ্বিজেন শর্মাকে ঘিরে জড়ো হয়েছিলেন বেশক’জন কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী। ২ নভে’র, মঙ্গলবার ব্রিকলেনের ক্যাফে গ্রিল রেস্টুরেন্টে বিকেল ৫টা থেকে শুরু হওয়া আড্ডার ব্যাপ্তি গড়ায় প্রায় মধ্যরাতের সীমানায়। উদীচীর উ”সবে অতিথি হিসেবে সম্প্রতি বৃটেন সফরে এসেছিলেন দ্বিজেন শর্মা। এ সুবাদে বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সমাবেশে যোগদান ছাড়াও নানা আড্ডা-আসরে সঙ্গ তিনি। দীর্ঘ এই আড্ডা শুধুই আড্ডার আক্ষরিক অর্থে থেমে থাকেনি। বরং তা রূপানত্মর লাভ করে সাহিত্যিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রসঙ্গের আনন্দঘন আহরণ সমাবেশে।
তিনটি টেবিলকে নিজেদের মতো আগলে রেখে এগুচ্ছিলো আমাদের আড্ডা। চা-কফির ধোয়া আর কারো কারো পানপরাগ সহকারে তা’ুল গ্রহণের ফাঁকে ফাঁকে চলছিল একথা-সেকথা। টেবিলগুলোকে আরো ব্যতিক্রম রূপ এনে দিয়েছিলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাম্প্রতিক প্রকাশিত কিছু সাহিত্য বিষয়ক সাময়িকী ও প(িড)কা-পুসিত্মকা। কাচামরিচ আর ভাজা মরিচ সহকারে চানা, পিয়াজু ভক্ষণ পর্ব চললো হা-হু করে। আর সমাপ্তি লগ্নে ভুরি-ভোজতো ছিলোই। তুমুল আড্ডার মধ্যেও মধ্যমনির মুখ নি”সৃত কথার নোট রাখতে ও রেকর্ড করতে ভুললেন না কবি আনোয়ারুল ইসলাম অভি। কথা হলো নানা বিষয়ে, কখনো পারস্পরিক কখনো সম্মিলিত।

ভাবনার বারান্দায় বাংলাদেশ :
দ্বিজেন শর্মার সার্বক্ষণিক ভাবনায় বাংলাদেশের পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন। দেশজুড়ে যখন নাম বদলের নিকৃষ্ট চর্চা তথা প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশ এবং জনগণের উন্নয়নের অনত্মরায় হয়ে দেখা দিয়েছে তখন শিল্প-সাহিত্যের অনির্ধারিত আলোচনায়ও সে বিষয়টি ঘুরে ফিরে চলে আসে। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে যাক বা না যাক তখন সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের মনত্মব্যেও অবলিলায় সে বিষয়টি স'ান করে নেয়। কারণ, যারা বিশ্বাস করেন শুধু শিল্পের জন্য শিল্প চর্চা নয়, সমাজ বিনির্মাণেও শিল্প-সাহিত্যের অবদান অনস্বীকার্য তখন রাজনৈতিক তিক্ত বিষয়গুলোও আর পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না। দ্বিজেন শর্মা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রাজনৈতিক সি'তিশীলতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, বিশ বছর পর কি হবে তা নিয়ে রাজনীতিবিদদেরকে ভাবতে হবে। নাম বদল, সাইনবোর্ড পরিবর্তন ইত্যাদি না করে জনসংখ্যার বিস্ফুরণ, ক্লাইমেট চেঞ্জের মতো বিষয়গুলো মোকাবেলায় সবাই মিলে বাসত্মবসম্মত পরিকল্পনা করা উচিত।
কবি ও সাহিত্যকর্মী ইকবাল হোসেন বুলবুলের বদান্যতায় জমে উঠা আনন্দঘন আড্ডায় গালগল্পের ফাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে উপরোক্ত বিষয়-ভাবনা ছুড়ে দেন দ্বিজেন শর্মা। অনেকটা আকস্মিকভাবে আয়োজিত আড্ডায় দ্বিজেন শর্মাকে ঘিরে শিল্প-সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ-অনুসঙ্গ বিষয়ে আলাপচারিতায় অংশ নেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট উর্মি রহমান, সাংবাদিক ইসহাক কাজল, লেখক-গবেষক ফারুক আহমদ, কবি ও নাট্যকার মুজিবুল হক মনি, সংহতি সভাপতি কবি ফারুক আহমদ রনি, কবি আতাউর রহমান মিলাদ, সাপ্তাহিক সুরমার সাহিত্যি সম্পাদক কবি আহমদ ময়েজ, নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘নারী’র সম্পাদক কবি শাহনাজ সুলতানা, কবি ও টিভি উপস'াপক তাবাসসুম ফেরদৌস, সাংস্কৃতিক কর্মী ও ছড়াকার লোকমান আহমদ এবং কবি আনোয়ারুল ইসলাম অভি।

যে স্মৃতি স্বযত্নে ধরে আছেন উর্মি রহমান :
বাংলাদেশ, কলকাতাসহ বিশ্বের নামি-দামি কবি-সাহিত্যিক, লেখকদের লেখাজুখা এবং জীবনচারণের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতা চলতে থাকে আড্ডার সিংহভাগ জুড়ে। আবার নানা কারণে বিভিন্ন লেখকের পদস্খলনের কথাও আলোচনায় স'ান পায়। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত লেখকদের সাথে আমাদের দেশের অনেক একনিষ্ট ও ধ্রুপদী লেখকদের জীবন সংগ্রামকে মেলাবার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে শক্তিমান কথা সাহিত্যিক আখতারশুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান এবং শওকত আলীর শিল্পীসত্ত্বার নানাদিক আলোচনার একটা বিরাট অংশ ধকল করে রাখে। আর এতে করে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন আড্ডার আরেক ব্যক্তিত্ব উর্মি রহমান। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, একদা তার বুক সেলফে থাকা ‘খোয়াব নামা’ গ্রন'টির প্রুফ নিজ হাতে সংশোধন করে দিয়েছিলেন ইলিয়াস ভাই। জানালেন, স্মৃতির স্মারক হিসেবে সেই কপিটি তিনি আজও স্বযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন।

গোর্কীর মা বিষয়ক মতানত্মর :
ইতোমধ্যে আমরা চানা-পিয়াজু এবং একথা-সেকথার ফাঁকে এক পর্ব চা গ্রহণ সমাপ্ত করে ফেলেছি। সময় প্রায় মধ্যভাগে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন আমাদের সাথে এসে সম্পৃক্ত হলেন কবি আহমদ ময়েজ। তিনি এসেই অতিথির সাথে পরিচিত হয়ে সরাসরি তার রাশিয়ায় যাপিত জীবন সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পরই তিনি বিশ্ববিখ্যাত রাশিয়ান সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির সুখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করে অতিথির মূল্যায়ন জানতে চাইলেন। অতিথিও সংক্ষেপে ‘মা’র প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয়তারই সমর্থন করলেন। বলেলন, মা একটি ইউনিভার্সেল বিষয় এবং সেখানে একটি সংগ্রামী মার চি(ড) ফ*টে উঠেছে। কিনত্ম* আহমদ ময়েজ তার কয়েকবারের পাঠানুভূতি জানিয়ে বললেন, মা চরি(ড)টি আমার কাছে একটি আরোপিত চরি(ড) বলেই মনে হয়েছে। এখানে লেখক তার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে তার মতো করে একটি চরি(েড)র সৃষ্টি করেছেন। দেখা যায় এ লেখকের ‘মা’ এর মা এবং আ(র)জৈবনিক উপন্যাস ‘আমার ছেলেবেলা’র মা চরি(েড)র মধ্যে বিসত্মর ব্যবধান। বরং গোর্কির ‘মা’ এর চেয়ে ‘আমার ছেলে বেলা’ই তাকে বেশী আকৃষ্টি করেছে বলে মত প্রকাশ করেন আহমদ ময়েজ। এক পর্যায়ে দ্বিজেন শর্মাও একমত হলেন। বলেলন, রাশিয়ায় বেড়ে ওঠা এবং সেখানে পড়ুয়া তার সনত্মানরা তথা এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও তাই ভাবে। রাশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, অনেকে বিপ্লবী লেলিনের নামও আজ ভুলে গেছে।

সৃজনশীলতায় স্বজনপ্রীতি এবং :
আলোচনার এক পর্যায়ে বৃটেনে বাঙালি কমিউনিটিকে নিয়ে লেখালেখি তথা এখানকার শিল্প সংস্কৃতি চর্চার বিষয়টি আলোচনায় স'ান করে নেয়। আড্ডার প্রায় সমাপ্তিলগ্নে সংস্কৃতিকর্মী লোকমান আহমদ আমাদের সাথে যোগ দেন। এসময় তার সাথে ছিলো সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকজন তরুণ বৃটিশ বাঙালির লেখা ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র লোকায়িত গল্পের সংকলনগ্রন' ‘পলাশি লিগ্যাসি’র বেশ ক’টি সংখ্যা। তিনি বসেই তা অতিথিকে দেয়ার পাশাপাশি সবার হাতেও একেকটি করে তুলে দিলেন। ত”ক্ষণাত বইটি একনজর নেড়েচেড়ে দেখে নিলেন সবাই। অতিথির উদ্দেশ্যে বইটির প্রশংসা করে পাশে বসা কবি ফারুক আহমদ রনি জানালেন, বইটিতে যাদের লেখা স'ান পেয়েছে তারা সবাই এখানে বেড়ে ওঠা বাঙালি তরুণ-তরুণী এবং এটি এখানকার নতুন প্রজন্মের উপযোগি একটি প্রকাশনা।
এরই সূ(ড) ধরে ইতিপূর্বে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক গোলাম মুর্শেদের ‘কালাপানির হাতছানি বিলেতে বাঙালির ইতিহাস’, চারিদিকে হইচই ফেলে দেয়া মনিকা আলীর উপন্যাসগ্রন' ‘ব্রিকলেন’ এবং তাহমিনা আনামের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন' ‘গোল্ডেন এইজ’ এর বিভিন্ন ভুল তথ্য ও আজগুবি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন সাংবাদিক কলামিস্ট উর্মি রহমান। গোলাম মুর্শেদের মতো একজন বিজ্ঞ লেখকের ঐতিহাসিক পটভূমির উপর রচিত বইয়ে কী করে অতি সাধারণ তথ্যের ভুল সন্নিবেশ ঘটে, তার জন্যে বিস্ময় প্রকাশ পায় সবার কথায়। উর্মি রহমান তাহমিনা আনামের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রনে' প্রচ*র ভ*ল তথ্য থাকা সত্ত্বেও গ্রন'টির প্রশংসা করে একজন অধ্যাপক কর্তৃক আলোচনা লেখায় এবং তা আবার প(িড)কায় প্রকাশ পাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি আরো জানান, পরবর্তিতে তিনি এব্যাপারে সেই অধ্যাপকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অধ্যাপক সাহেব হেসে উত্তর দিয়েছিলেন ‘বুঝেন না, বন্ধুর মেয়েতো!’

একজন দ্বিজেন শর্মা এবং তার যাপিত জীবন :
দ্বিজেন শর্মা। একাধারে লেখক, অনুবাদক, শিশু সাহিত্যিক ও পরিবেশবিদ। যার জীবন দুপুরের দুর্দানত্ম প্রহরগুলো কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়ায়। প্রগতি প্রকাশনার সাথে অনুবাদকের কাজ করে প্রবাস জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর আসেত্ম আসেত্ম সে পেশারও ইতি ঘটে। তারপর স্কুলে শিক্ষকতা করে কাটান আরো কিছুকাল। অত”পর দীর্ঘ ১৮ বছরের প্রবাস জীবনের বলয় ভেঙ্গে ২০০২ সালে সবকিছু চুকিয়ে ফিরে আসেন জন্মভূমি বাংলাদেশে। জানালেন ১৯৫৬ সালে প্রগতি এবং রাধুকা প্রকাশনার প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো রাশিয়ায়। রাজনৈতিক সাহিত্যের জন্য কাজ করতো প্রগতি এবং সৃজনশীল সাহিত্যের কাজ ছিলো রাধুকার। প্রবাস জীবনের গল্পগাঁথা বিবৃত করতে গিয়ে জানালেন, প্রগতির হয়ে অনুবাদকের কাজ করতেন তিনি এবং পেশাগত এ কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতো শিশু সাহিত্য ও সায়েন্স ফিকশন্স চর্চা। গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ মিলিয়ে এযাব” এ লেখকের ১৫/১৬ বই প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রথম বইটি ছিলো বিবর্তনবাদের বিশ্লেষক চার্লস ডারউনকে নিয়ে ‘পিতামহ চার্লস ডারউইন’ নামে এবং তার দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুয় ‘সতির্থ বলয়ে ডারউন’ শিরোনামে। জানালেন, আগরতলা মহারাজা কলেজে আইএসসি পড়ার সময় ‘যে নদী মরুপথে’ কলেজ বার্ষিকীতে গল্প প্রকাশের মাধ্যমে সূচনা লেখক জীবনের। লিখতেন ছদ্মনামেও। শিশু সাহিত্য এবং সায়েন্স ফিকশনেও তার রয়েছে ভালো দখল। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। ছেলে, মেয়ে দু’জনই বিবাহিত। ছেলে রাশিয়ায় থেকে গেলেও মেয়ে বসবাস করছেন বৃটেনে। দ্বিজেন শর্মার বর্তমান স'ায়ী নিবাস ঢাকায়, পিতৃভূমি বৃহত্তর সিলেটের বড়লেখায়। এখনও সামাজিক, সাহিত্যিক অঙ্গনে নিজেকে পুরোদমে ব্যসত্ম রেখেছেন। চ্যানেল আই’এ পাক্ষিকভাবে প্রচারিত প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন’ এর প্রায় নিয়মিত কথন এবং নেপথ্য ব্যক্তিও দ্বিজেন শর্মা।

 

 

1971 J R K p1.jpg
1971 J RK page 2.jpg
bottom of page